১৯৯৭ সাল, বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি টুর্নামেন্টে প্রতিদ্বন্দিতা করছে কেনিয়ার সাথে, ভীষন উৎকন্ঠা আর উদ্বেগের সাথে প্রতীক্ষা চলছে খেলা নিয়ে , টিভিতে খেলা দেখান হচ্ছে না, তবে রেডিও তে সরাসরি ট্রান্সমিটেড করছে আমাদের দুই সেরা ভাষ্যকার চৌধুরী জাফরুল্লাহ সরাফত এবং খোদা বক্স মৃধা । রেডিও তে আমরা সবাই সজাগ কর্ণপাত করে আছি বাসার পাশের চায়ের দোকানে , এই দোকানে আমরা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেই বাড়ি তে এলেই, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি, সামনে কোরবানীর ঈদ, ছুটিতে বাড়ি এসেছি, ঠিক সেই সময়ে এই ঐতিহাসিক খেলাটি হচ্ছে,সুতরাং আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের সীমা নেই । আমরা থাকতাম কলোনীতে , পিতার কর্মস্থল হিসেবেই এখানে থাকা, কলোনীর ভিতরে স্কুল ,বিশাল মাঠ, মসজিদ, মক্তব সব আছে আর আছে প্রবেশ দ্বারে বিশাল এক আম্রকানন, স্কুলে পড়ার সময় মাঝে মাঝে ভাবতাম পলাশীর প্রান্তরের আম্রকানন বুঝি এই রকমই , ছুটিতে বাড়ি এলেই শুধু ঘোরাঘুরি আর আড্ডা ,বাসায় খাবারের সময় এবং ঘুমের সময় ছাড়া একদন্ডও থাকা হত না, বাসার পাশেই মাঠ আর মাঠের শেষ প্রান্তে ছিল বাবা চাচাদের ক্লাবঘর যার একপাশেই আমাদের সেই আড্ডার স্থান আলমগীর মামুর দোকান, সেই মামু আবার আমাদের বয়সী একাডেমিকভাবেও ইয়ারমেট ছিল, আমরা সিগারেট খেতাম ওর দোকানে খুব গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে পাছে বাপ চাচারা কেউ না দেখে ফেলে, সকলেই সিগারেট খেয়ে শেষের অংশটুকু মামুকে দিতাম আর মামু সুখ টান দিত চোখ বন্ধ করে, চোখ খুলতেই দেখত তার বাবা দাঁড়িয়ে, আর সকলের মাঝে হাসির রোল পড়ে যেত । যথারীতি আজকের এই খেলাশ্রবনের স্থান টিও আলমগীর মামুর দোকান, আর মাঠে বাধা আছে বিভিন্ন জাতের গরু যা কোরবানীর ঈদের জন্য কেনা , সবাই নিজ নিজ গরু গুলোকে বেধে ঘাস খাওয়াচ্ছেন, আর আমরা এই দোকানে বসে বসে ধুম্রটান এবং খেলাশ্রবন করছি, রেডিও তে ভেসে আসছে খোদা বক্স মৃধার সেই চিরচেনা স্বর- আটার সুজি নয়,ময়দার সুজি নয় , এ হচ্ছে মার্টিন সুজি, এগিয়ে আসছেন মার্টিন সুজি ! হাহাহাহা এটা কি ধরনের উপমা বোঝা গেল না ?খুব শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চলছে, কেনিয়া প্রথমে বেটিং করে ৫০ ওভারে ২৪১ রান ৮ উইকেটে, স্টিভ টিকোলো করেছে ১৪৭ রান , ভীষন চিন্তিত সবাই , Duckworth-Lewis method এ বাংলাদেশ কে করতে হবে ২৫ ওভারে ১৬৬ রান, সকলেই খুব মনোযোগী খেলার মাঝে এর মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম আমাদের এক বন্ধু (দূর সম্পর্কের!) জাহাংগীরের আব্বা মোবারক চাচা মাঠে তাদের ঈদের গরুটি কে ঘাস খাওয়াচ্ছেন, ভীষন peculiar এই মোবারক চাচার জন্য আমরা ঈদের দিনে বলতাম-ঈদ জাহাংগীরের আব্বা ! আমরা কিছুক্ষন পর পর চার ছক্কার কল্যানে চিৎকার মেরে উঠি আর উনি রাগী রাগী চোখে আমাদের দিকে তাকান, উল্লেখ্য যে সেই সময়েও ক্রিকেট এত বেশি পরিমানে জনপ্রিয় ছিল না , অনেকে জানতই না যে খেলা হচ্ছে, পাশেই ক্লাবে বসে অনেক চাচারাই খোশ গল্প করছিলেন,ক্যারাম খেলছিলেন কিন্তু খেলা শুনছেন এমন সংখ্যা খুব বেশি নয়, চার ,ছক্কা আর সিংগেলসে একে একে সেই মুহুর্ত এল, খালেদ মাসুদ পাইলটের সেই ত্রাতাবাহী রান টি হবার সাথে সাথেই সবাই এক সাথে হুররাহ দিয়ে চিৎকার আর সাথে বুড়িমার চকলেট বোমের ফটকাবাজ়ি, কিছুক্ষনের জন্যে আনন্দ আর প্রাপ্তির ডামাডোল আর উচ্ছ্বাসের দামামায় মোহিত হয়ে গেল সব, - বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলছে- এই আনন্দে ভাসতে ভাসতে আনন্দ মিছিল আর রঙ্গে রঙ্গিন হতে লাগলাম, সেকি আনন্দ যা বোঝান যাবে না , আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ! সন্ধ্যার দিকে দেখি মাঠে জটলা , কি ব্যাপার ? ঈদ জাহাংগীরের আব্বা আমাদের সব বন্ধুদের ডেকেছেন, আমিও গিয়ে বিড়ালের মত চুপ করে বসলাম, সবাই নিস্তব্ধ- উনি একাই বলছেন। কি লাভ হইছে তোমাগো ? এই যে তোমরা সবাই হাউ হাউ কাউ কাউ করলা বোম ফুটাইলা তাতে কি কেউ তোমাগো দশ টেকা দিছে ? মাঝখান দিয়া তোমাগো বোমের শব্দে আর চিল্লানিতে আমার এত শখের কোরবানীর গরুটা রশি ছিড়া পালাইছে, এই গরু ধরতে আমরা চার জন মানুষ আট মাইল দৌড়াইলাম ,দৌড়াইতে দৌড়াইতে জান শেষ! এখন কও তোমাগো কী বিচার হউয়া দরকার ? আমি বন্ধু বুলেট, রানা, আজাদ, রুস্তম ,মাহাবূব আমরা সবাই জিহবাতে কামড় দিয়ে আছি হাসিঁ ঠেকাতে ,
আমরা বললাম কাকা আমরা এটা ইচ্ছা করে করি নাই, বাংলাদেশের এত বড় একটা খবর তাই আনন্দ আর ধরে রাখতে পারি নাই, উনি বলেন কি হইছে বাংলাদেশের ? আমাগো সবাইরে কি আমেরিকায় পাঠায় দিব নাকি ? তাইলে আর বড় খবর কি? বললাম বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে , উনি বলেন তাতে তোমাদের কি লাভ ? আমরা বললাম আমাদের লাভ কিছুই না তবে আপনার আরেকটা গরু যাতে দৌড় মারে সেই ব্যবস্থা হবে বিশ্বকাপে খেললে, এই কথা বলা মাত্রই আমরা যে যার মত দৌড়ে পালাই আর বলি
–বাংলাদেশ জিতে গেল
গরু একটা দৌড় মারল
মোবারকের ঈদ গেল
তাই না দেখে কান্না পেল,
আমরা সবাই হলুস্থুলে
বাংলাদেশকে জিতিয়ে নিয়ে
বিশ্বকাপে সবার মাঝে
প্রানের উত্তাপে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ।